বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) একটি জরিপে বলা হয়েছে, ৩৬ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু অনলাইনে বন্ধুদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। এ ছাড়া ২৭ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু পরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও আত্মীয় এবং ১৮ শতাংশ অপরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে অনলাইন–নির্ভরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি অনলাইনে হয়রানিও বেড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েদের জন্য অনলাইননির্ভর এই ভার্চ্যুয়াল জগৎ নিরাপদ নয়। মেয়েশিশুদের জন্য নিরাপদ অনলাইন গড়ে তুলতে কী করতে হবে, সে বিষয়ে নারীমঞ্চকে বলেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। গ্রন্থনা করেছেন সুহাদা আফরিন
সামাজিকভাবে সচেতনতা জরুরি
মোস্তাফা জব্বার, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী
আসক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে হয়রানির শিকার যারা হচ্ছে, তারা পরিচিতজনদের দ্বারাই হচ্ছে। এটা একটা ভয়ংকর তথ্য। এটাকে প্রতিরোধ শুধু আইন দিয়ে সম্ভব নয়। এই প্রতিরক্ষা নিজেকেও নিতে হবে। আমাদের এখানে যে ধরনের অভিভাবকত্ব থাকা দরকার, সেখানে ঘাটতি আছে। হয় তাঁরা প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না, না–হয় তাঁরা বুঝতে পারছেন না কী করে এই সংকটে ছেলেমেয়েদের নিরাপদে রাখবেন।
ইন্টারনেটের সব মাধ্যমেই অভিভাবকদের জন্য একটি গাইডলাইন আছে। সন্তান কী করে, কতক্ষণ সময় কাটাবে, কার সঙ্গে কথা বলছে না বলছে, এ সবই মনিটর করা সম্ভব। এগুলো আইন করে হয় না। প্রযুক্তি তো থামিয়ে রাখা যাবে না। করোনার মধ্যে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর হাতেও ফোন, ইন্টারনেট তুলে দিতে হয়েছে।
রাষ্ট্র আইন, তদন্ত এবং বিচারের ব্যবস্থা করতে পারে। এ–সংক্রান্ত আমাদের কিছু আইন আছে। অভিভাবকদের, ব্যবহারকারীদের সচেতনতা জরুরি। সরকার এককভাবে কিছু করতে পারবে না। সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে। মেয়েশিশু ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখা আমাদের দায়িত্ব।বিজ্ঞাপন
অভিভাবকদের জন্য গাইডলাইন দরকার
মইনুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নারীর প্রতি সহিংসতা যখন সমাজেই প্রতিষ্ঠিত, তখন অনলাইনে যে তা দেখা যাবে না, তা হয় না। যে সমাজে নারী–পুরুষ মিশতে শেখেনি এবং ছোটবেলা ছেলেমেয়ে আলাদা মনে করিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে ছেলেমেয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের জায়গায় ফারাক থেকে যায়। সে সমাজে এ ধরনের হয়রানি হওয়ারই কথা। এসব রোধে পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। অনলাইন একটা নতুন মাধ্যম। অভিভাবকেরা অনেক ক্ষেত্রে সচেতন নন। তাই অভিভাবকদের জন্য একটা গাইডলাইন দরকার। করোনার কারণে ইন্টারনেট জগতে অবাধ বিচরণ ঘটেছে। রাস্তায় আমরা ছেলেমেয়েদের যেমন একা ছাড়ব না, সুরক্ষার কথা চিন্তা করব, তেমনি অনলাইনেও তা ভাবতে হবে। ফেসবুকে মেসেঞ্জার কিডস নামে অপশন আছে, যেখানে মা–বাবা দেখতে পারেন সন্তান কার সঙ্গে কী আলাপ করছে।
স্কুলে এগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে। শিশুদের সঙ্গে ঘটনাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা ভালো। জ্ঞান দেওয়ার মতো করে বললে হবে না। সুন্দরভাবে বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক ও অভিভাবকদের বড় ভূমিকা রয়েছে। আবার মেয়ে বলে ইন্টারনেট কম ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। মেয়েরা যেন অনলাইনে নিরাপদ থাকে, সে দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে। অনেক মেয়ে যখন প্রযুক্তিতে আসবে, তখন এগুলো ধীরে ধীরে কমে যাবে।
অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানো হয় না
শাবনাজ জাহেরিন, শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ
ছেলেমেয়ে সবাইকে জানতে হবে অনলাইনে নিরাপদ থাকার বিষয়টি। একই সঙ্গে মা–বাবাকেও জানতে হবে। মনিটরিংয়ের একটা বিষয় যে আছে, তা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। বাচ্চারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তা আমরা জানি বা তারা শেয়ার করে। কিন্তু অনলাইনে সেটা অবধারিত। অনেক কিছুই জানা যায় না। তাই হয়রানিও বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ মা–বাবা ডিজিটাল জগৎ সম্পর্কে তেমন কিছু বোঝেন না। তাই তাঁরা মনিটরিংও কম করেন। তাঁদের জানতে হবে বা জানাতে হবে অনলাইনে কীভাবে সেফ থাকা যায়। যদি কিছু ঘটে তাহলে কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে—সেসব বিষয়েও জানতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অভিযোগ জানানো হয় না। সরকারি যেসব পদক্ষেপ আছে, তার প্রচার বাড়াতে হবে। সরকারিভাবে আমরা বলছি ডিজিটাল বাংলাদেশ, আমরা চাচ্ছি সবাই কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহার করুক। কিন্তু তারা সচেতন না অনেক ক্ষেত্রে।বিজ্ঞাপন
যারা ইন্টারনেটে হয়রানি করে তাদের শনাক্ত করা সহজ
আমেনা বেগম, উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), বিশেষ শাখা (প্রটেকশন অ্যান্ড প্রটোকল), বাংলাদেশ পুলিশ
এখন সবকিছুই অনলাইনভিত্তিক। মানুষ অনেক বেশি ইন্টারনেটনির্ভর হয়েছে। করোনার কারণে মেয়েশিশু থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েরাও ইন্টারনেটে অনেক বেশি যুক্ত। অনিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে অনেক। যারা এ ধরনের হয়রানি করবে, তাদের চিহ্নিত করা পুলিশের জন্য সহজ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে এবং কঠিন শাস্তি হবে।
সম্প্রতি পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সেবা চালু হয়েছে। এ ছাড়া ৭০০ থানায় নারী ও শিশু ডেস্ক রয়েছে। সেসব থানাতেও সাইবার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রতিটি জেলায় সাইবার ক্রাইম নিয়ে প্রশিক্ষিত টিম রয়েছে। স্কুল পর্যায়ে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, কোনটা নিরাপদ, কোনটা নিরাপদ না, সে বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
কীভাবে নিরাপদে থাকা যাবে, তা বলতে হবে
সাদাত রহমান, আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারজয়ী এবং উদ্যোক্তা সাইবার টিনস
অনলাইনের প্রতি বেশি বিশ্বাস রাখা যাবে না। নিজের ব্যক্তিগত তথ্য যত কম শেয়ার করা যায়, তত ভালো। অনলাইনে অপরিচিতদের সঙ্গে মেশা যাবে না। কারণ, সাইবার জগতে কোনো কিছুই নিরাপদ না। পরিচিত হলেও নিজের ব্যক্তিগত বিষয় যা ভবিষ্যতে ক্ষতির কারণে হতে পারে, তা শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, এগুলো হ্যাকড হতে পারে। যে কেউ ক্ষতি করতে পারে।
অনলাইনে নিরাপদ থাকার বিষয়ে প্রচুর সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে। স্কুল থেকে যদি বলে, ‘এই ফেসবুক, ইন্টারনেট চালানো যাবে না’, সেটা বাস্তবসম্মত হবে না। এ রকম কথা না বলে কীভাবে চালালে নিরাপদ থাকা যায়, সে বিষয়ে ধারণা দিতে হবে। তবে এ ধরনের হয়রানি একসময় কমে আসবে। আরেকটু সময় লাগবে।
উৎস: প্রথম আলো