আমার পরিচিত একজন ‘শিক্ষিত-ভদ্র নারী’ বাসার কিশোরী গৃহকর্মীকে মারতে মারতে মেরেই ফেলেছিলেন। কিশোরীর অপরাধ সে মাংস চুরি করে খেয়েছে। এই নিয়ে এলাকায় ব্যাপক হইচই হলো, তাদের বিরুদ্ধে অবরোধও করা হয়েছিল। এরপর এক লাখ টাকা দিয়ে মানুষ হত্যার হাত থেকে পার পেয়েছিলেন তিনি। যতদূর শুনেছি, তার ছোট ছোট সন্তানরা মায়ের এই অপরাধ ক্ষমা করতে পারেনি।
অথচ আমাদের পরিবারের শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি তখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সে সময় আমাদের বাসায় গৃহকর্মী ছিলেন নূরজাহান। একদিন আমি নূরজাহানের ওপর বিরক্ত হয়ে তাকে ধাক্কা মেরেছিলাম। তাই দেখে আম্মা খুব বকা দিলেন। যদিও নূরজাহান বলতে থাকলেন, ‘খালাম্মা কিছু হইব না। ওতো ছোট মানুষ, রাগ হইয়া করছে।’ কিন্তু, আব্বা-আম্মার কাছে আমার এই আচরণটি ছিল খুবই গর্হিত অপরাধ।
আব্বা আমাকে নূরজাহানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আদেশ দিয়ে বললেন, ‘মনে রাখবি, দুটো খাবারের জন্য মেয়েটি আমাদের বাসায় কাজ করতে এসেছে। ওর জন্য এটা খুব কষ্টের একটা অনুভূতি।’ আব্বা আরও বলেছিলেন, এরপর থেকে যেন কখনো গৃহকর্মীর গায়ে হাত না তুলি। কোনো অভিযোগ থাকলে যেন আম্মাকে জানাই।
সেই প্রথম, সেই শেষ। এরপর কোনোদিন আমি কারো গায়ে হাত তুলিনি ও খারাপ আচরণ করিনি। কাউকে পছন্দ না হলে অসুবিধা সত্ত্বেও বিদায় করে দিয়েছি। এই কথাগুলো এজন্য বললাম যে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা যেমন, আমরা সেরকম আচরণের শিক্ষাই পাই। বাড়িতে থাকা সাহায্যকারী মানুষটিকে আমরা যদি পরিবারের সদস্য বলে মনে করি, তাহলে তিনিও হয়তো নিজেকে সেইভাবেই তৈরি করবেন। এর প্রমাণও আমি বহুবার পেয়েছি।
মনে করার কোনো কারণ নেই যে মানুষ শুধু ধনী হলে বা শিক্ষিত হলেই তার অধীনস্থ মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে। টাকাওয়ালা আত্মীয়ের বাসাতেও দেখেছি ওয়ার্কিং স্টাফের জন্য কমদামি খাবার, আলাদা চাল, আলাদা রান্না। উচ্চশিক্ষিত ও ধনী পরিবারের মানুষ কেন সামান্য চুরি করে খাওয়ার দায়ে শিশু গৃহকর্মীকে পিটিয়ে মেরে ফেলে? অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য কেন বনেদি এলাকার ভবনের ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় দুই গৃহকর্মীকে? কেন এই সেদিনও উত্তরায় একটি শিশু গৃহশ্রমিককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো? ১০ বছরের গৃহকর্মী আছিয়া কেন নির্মম নির্যাতনের শিকার হলো? এরকম নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা একটার পর একটা ঘটেই চলেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ২২ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়ে নিহত হয়েছেন ১০ জন। ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। এরপর আছে ৭ থেকে ১২ বছরের শিশুরা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এদের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে আট জন, ধর্ষণের শিকার চার জন, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার একজন, মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি ছয় জনের, আত্মহত্যা দুই, শারীরিক নির্যাতনের পরে মৃত্যু হয়েছে একজনের। মামলা হয়েছে ১১টি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের চলতি বছরে প্রকাশিত ‘শিশু সংক্রান্ত প্রতিবেদন ২০১৯ : সংবাদপত্রের পাতা থেকে’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মোট ১৪ শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ১২ জন মেয়ে শিশু, এক জন ছেলে শিশু। আর একজন শিশুর ক্ষেত্রে ছেলে না মেয়ে, সেটি উল্লেখ করা হয় নাই। আটটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
ইদানীং গৃহকর্মীদের ওপর, বিশেষ করে শিশু গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার অনেক বেড়েছে। যদিও ঘন ঘন গৃহকর্মী নির্যাতনের সংবাদ আসছে, কিন্তু বাস্তবে এর চেয়েও বেশি গৃহকর্মী নির্যাতিত হচ্ছে। অধিকাংশ নির্যাতনের ঘটনার কোনো মামলা ও বিচার হয় না। যেহেতু গৃহকর্তারা পয়সাওয়ালা ও ক্ষমতাশালী, তাই চাপ দিয়ে কেস তুলে নিতে বলে বা সালিশ করে।
রেজিস্ট্রেশন করা হয় না বলে এবং গৃহশ্রমিক হিসেবে কোনো পরিচয়পত্র বা নিয়োগপত্র থাকে না বলে ঠিক কতজন, কোথায় কাজ করছেন, এটাইতো জানা যায়না। আর সেই কারণেই জানা যায় না কতজন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশে গৃহকর্মী হিসেবে সবচেয়ে বেশি নিয়োগপ্রাপ্ত এবং নির্যাতিত হয় বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েরা।
২০০৭ সালেই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফ বলেছে, ৪ লাখ ২০ হাজার শিশু গৃহশ্রমিকের বয়স ৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। এদের বেতনের মাপকাঠি নেই, নেই কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়। গ্রাম থেকে শহরে আসা এইসব মেয়েদের দরিদ্র, নিরক্ষর ও অসহায় পরিবারগুলো তাদের সঙ্গে ঘটা অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না। বাবা-মায়েরা শিশুদের কাজে পাঠায় এজন্য যে তাদের সন্তান অন্তত তিন বেলা খাবার পাবে। কিন্তু, এর বদলে কপালে জোটে মারধর ও সহিংসতা।
এই গৃহকর্মী নামের মানুষগুলো সারাদিন কাজ করার পরও শ্রমিক হিসেবে গণ্য হয়নি। বাসাবাড়িতে যারা স্থায়ীভাবে কাজ করেন, তাদের নিজেদের সময় বলে সাধারণত কিছু থাকে না। যারা ছুটা বা অস্থায়ী কাজ করেন, তাদের সারাদিনে অন্তত ১০ থেকে ১৫টা কঠিন কাজ করতে হয়। এরপরেও এদের বেতন ও অধিকার রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের অবদানকেও জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। অথচ শ্রমিকের জন্য আইন সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ ও আমাদের সংবিধানে আছে। যেহেতু গৃহকর্মীরা শ্রম আইন ২০০৬ এর বাইরে আছেন, তাই তারা সব অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো— বাসায় থাকার পরও তারা শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ আছে। সেই নীতিমালায় গৃহকর্মীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, তাদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ, নির্যাতন না করা, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা বিধান করা, ভরণপোষণ দেওয়া, ছুটি ও প্রণোদনাসহ আরও সুবিধাদির কথা স্পষ্ট করে বলা আছে। কিন্তু, এই নীতিমালা থেকে আইন হয়নি এতগুলো বছরেও। এখানে যে ১৬টি শর্ত বা বিধান দেওয়া আছে— তাতে নিয়োগকর্তা, শ্রমিক ও সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, কোনোরকম মনিটরিং করা হয় না বলে গৃহকর্মীদের প্রতি নির্যাতন ক্রমাগত বাড়ছে।
১৯৭০ সালে গৃহশ্রমিকের অধিকার নিয়ে প্রথম কথা বলেছিল পথশিশু ও বঞ্চিত শিশুদের অধিকার নিয়ে কর্মরত এনজিও ‘সুরভি’। এর বহুবছর পর জাতীয় নারী গৃহশ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়, কেন শ্রম আইন ২০০৬ এ কেয়ারগিভার হিসেবে গৃহ শ্রমিকদের কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি? অথচ আইএলও বহুবছর যাবৎ গৃহশ্রমিকের স্ট্যাটাস কেয়ারগিভার বা হাউস-কিপার হিসেবে গণ্য করার কথা বলে আসছে। কিন্তু, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা সম্ভব হচ্ছে না।
শ্রম আইনে গৃহশ্রমিকের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার দাবিটি অনেকদিন ধরে বিভিন্ন স্তরে আটকে থাকল। ২০১১ সালে এসে একটি মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক দায়ের করা মামলায় বাংলাদেশ হাইকোর্ট জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে ১০টি পয়েন্ট উল্লেখ করে একটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যেখানে শিশুশ্রমিক রাখা নিষিদ্ধ করা হয় এবং শ্রম আইনের খসড়া দ্রুত অনুমোদন করতে বলা হয়।
বাংলাদেশে কর্মরত ২০ লাখেরও বেশি মানুষ, যার অধিকাংশই নারী ও শিশু বিভিন্ন গ্রাম থেকে কাজের প্রয়োজনে শহরে এসে এই পেশা গ্রহণ করেছেন। এই গৃহশ্রমিকের আয় দিয়ে তারা নিজেরা চলে, সংসার চালায়, সন্তানের পড়াশোনা চালায়, গ্রামে বাবা-মাকেও টাকা পাঠায়। এ ছাড়াও, আন্তর্জাতিক বাজারেও নারী গৃহকর্মী পাঠায় বাংলাদেশ। এই অভিবাসী নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনি আমরা জানি। অথচ এই সুরক্ষা নীতিমালায় কিন্তু তাদের কথা আসেনি। আর শ্রম আইনেও তাদের কথা বলা হয়নি। অথচ আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যে শ্রম খাতের কথাই বলি না কেন, শ্রমিক যেন নির্যাতনের শিকার না হয়, এটাই হবে শ্রম আইনের মূল কথা।
খুব বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, গৃহকর্মী রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৯৬১-ই একমাত্র সম্পৃক্ত একটি আইন, যেখানে ঢাকা শহরে কর্মরত গৃহকর্মীদের নাম কাছাকাছি থানায় লেখানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া, পেনাল কোড, দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গৃহকর্মীদের নির্যাতন করার দায়ে কিছু শাস্তির কথা থাকলেও, সেটার প্রয়োগ খুবই সামান্য।
কোনোরকম অধিকার ছাড়া গৃহশ্রমিকের এই জীবনটাকে দাসত্বের অন্ধকার জীবন বলা যায়। অনেক গৃহকর্মী মার খেয়ে পালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে, পাচারকারী বা খারাপ মানুষের হাতে পড়ে যৌন ব্যবসায় চলে যায়। অন্যদিকে অনেক গৃহকর্মীর বিরুদ্ধেও বেয়াদবি, চুরি, খারাপ আচরণ ইত্যাদি নানারকম অভিযোগ আছে।
সেই কারণেই নিবন্ধনকৃত কোনো জায়গা থেকে যদি গৃহশ্রমিক সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে দুই পক্ষের দিক থেকেই ভালো হবে। এটা বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে এসে নিয়মিত মনিটরিং ও দোষীদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া, রেজিস্ট্রেশন করা, তদন্ত চালানো, নজরদারি বাড়ানো, শাস্তি দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলোকে শ্রম আইন ও গৃহকর্মে নিযুক্ত শ্রমিকের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নীতিমালার আওতায় আনতে হবে।
প্রয়োজন হলে মানুষকেও মানবিক হতে বাধ্য করতে হবে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বা কাজ পছন্দ না হলে তাকে বিদায় দিয়ে দেয়া উচিত। গৃহকর্মীদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা, ঠিকমতো খাওয়া, কাপড়, চিকিৎসা, বিশ্রাম এবং সর্বোপরি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদেরকে যৌন হয়রানির হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই, এমনকি ভারতেও গৃহশ্রমিক সরবরাহ ও অভিযোগ জানানোর নিয়মতান্ত্রিক সংস্থা আছে। গৃহশ্রমিকদের ও নিয়োগদানকারীদের ভালোর জন্যই গৃহকর্মীদের জন্য চুক্তিনামা, নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সময়মতো বেতন ও উৎসব ভাতা, বিশ্রাম, চিকিৎসা সুবিধা, শিক্ষা, আনন্দ, ঘুম, পরিচ্ছন্নতার সুবিধা থাকতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, গৃহকর্মী মানে দাস নয়। আমি আমার নিয়োগকর্তার কাছ থেকে যেরকম ব্যবহার প্রত্যাশা করি, আমারও উচিত সেই ব্যবহারই আমার অধীনস্থদের প্রতি করা।
Source: শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন