মেয়েটা অনেক দিন ফোন করে না৷ ধরেও না৷ দিনে বারকয়েক ফোনটা অন করে৷ তাও রুচি হয় না অচেনা নম্বরের এসএমএস খুলতে৷ সে দিন কথা হলো অনেক মাস বাদে৷ ফোন বন্ধ থাকার কারণ জানালো, জ্বালাতন৷ নতুন সিম নিতে বললে একটা ক্লান্তির হাসি দিয়ে জানালো, লাভ নেই, কয়েক দিন পরই আবার শুরু হয়ে যায় নোংরামো৷ আস্তে আস্তে ঝাঁপি খুলে দিলো কথার৷ বাবা ক্ষেপে আছে, বাবা-মেয়ের কথা হয় না অনেক মাস৷ কারণ সেই নোংরা কল আর এসএমএসগুলো৷ আগে গালাগাল করতো, তাতে বরং ফুর্তি বাড়তো নোংরা কলারদের৷ এসএমএস সব সেক্সুয়াল প্রোপোজে ভরা, কোনোটা সরাসরি টাকার উল্লেখ করে৷ একবার এক বুড়োটে গলার রোমিও জানিয়েছিল, ফোনে সেক্সের আহ্বানের সঙ্গে নাম আর নম্বর পেয়েছি একটা বাংলা সেক্স চ্যাট রুমে৷ নম্বর বদল করলেও কয়েক দিন পর কোত্থেকে যেন ছড়িয়ে পড়ে আবার৷ ফাঁদ পাতলাম, অল্প কয়েকজন বান্ধবী ও সহপাঠিনী- ওদের ফাঁদে ফেলা হলো৷ পাওয়া গেল কালপ্রিট৷ মেয়েটার এক সহপাঠিনী তার বয়ফ্রেন্ডের বন্ধুদের নিয়মিত মেয়েটার নম্বরে আপডেট জানাতো বলে অপরাধী ধরা পড়েছে৷ মিটে গেছে আপাতত৷ তবু ঘরের স্বাভাবিক সম্পর্কের সুরটা সেই যে কেটে গেছে, এখনো কেমন যেন ছাড়া ছাড়া বাজে৷ ঘটনা ২ জেরিন (ছদ্মনাম)৷ থাকে খিলগাঁও৷ বাসা থেকে প্রতিদিনই বেরুতে হয়৷ ক্লাস এইট শেষ করে নাইনে উঠেছে এবার৷ ওর বড় বোন বিবিএ থার্ড ইয়ারে পড়ে৷ কিন্তু প্রত্যেকটা দিনই ওদের শুরু করতে হয় অজানা আশঙ্কা নিয়ে৷ বাসার সামনে কয়েকটা ছেলে বসে থাকে৷ শুধু তাই নয়, ছেলেগুলো জেরিনের স্কুলের এক ছেলে ক্লাসমেটের কাছ থেকে ওর বড় বোনের মোবাইল ফোন নম্বর জোগাড় করে৷ এরপর ওই ছেলে ক্লাসমেটের নাম দিয়ে ফোন করে মোবাইলে৷ জেরিন প্রথমে বোঝেনি৷ পরে বখাটে ছেলেগুলো যখ। বলে তারা তাদের বাসার সামনে প্রতিদিন বসে থাকে, তখন জেরিন বুঝতে পারে৷ জেরিনের ওই ক্লাসমেটকে জিজ্ঞস করলে সে বলে, ওই ছেলেগুলো তার বড় ভাইয়ের বন্ধু-বান্ধব৷ কিন্তু ক্লাসমেট বুঝতে পারেনি, মোবাইল নম্বর দেওয়ার ফল এই দাঁড়াবে৷ এখন প্রতিনিয়ত ওই সব ছেলে ফোন করে যন্ত্রণা করছে৷ মোবাইল সিম পাল্টেও লাভ হচ্ছে না৷ কারণ ওরা বাসার সামনেই বসে থাকে৷ ইদানীং দূর থেকে মন্তব্যও করে৷ জেরিন এবং ওর বড় বোন বোঝে, মন্তব্যগুলো ওদের উদ্দেশ করেই ছোড়া হয়৷ এই রকম মানসিক অশান্তি নিয়ে রাজধানী শুধু নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মেয়েরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে৷ এ যেন ভয়ানক দুঃস্বপ্ন৷ এ অন্ধকারের গল্প কখন শেষ হবে মেয়েরা তা জানে না৷ কেন ছেলেরা এসব করে? মানসিক বিকৃতি? মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই? মায়ের প্রতি ভালোবাসার অভাব? কী আসলে? সমস্যাটা কোথায়? আমার মনে হয় না, শুধু শিক্ষিত হলেই, এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ কারণ আমার আশপাশে আমি দেখেছি, বহু শিক্ষিত ছেলেও সুযোগ পেলে ইভটিজিং করতে ছাড়ে না৷ প্রায়ই পত্রপত্রিকায় আমরা দেখছি যে বখাটে যুবকদের উত্পাতে মেয়েরা রাস্তাঘাটে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে না? আমাদের দেশে প্রতিদিন কত মেয়ে এভাবে রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত ও হয়রানির শিকার হচ্ছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও এটা বলা যায় যে, এ ধরনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে? ফলে নারী, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতার কারণে লেখাপড়া ছেড়ে ঘরবন্দি জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে৷ অনেকের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে৷ এই ইভটিজিংয়ের প্রকোপ বর্তমানে এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে খিলগাঁওয়ের সিমি, মিরপুরের ফাহিমা, খুলনার রুমি, গাইবান্ধার তৃষা, স্বপ্না, সাভারের তিথির মতো অসংখ্য কিশোরী নিজের জীবনের সমাপ্তি টেনেছে আত্মহননের মধ্য দিয়ে৷ উত্ত্যক্ত ও হয়রানির ঘটনায় বাংলাদেশে যেভাবে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোথাও সেরকম নেই৷ অবশ্য অন্যান্য দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আইনি প্রতিকার পাওয়া যায়৷ আর আমাদের দেশে আইনি প্রতিকার তো দূরের কথা, এরকম ঘটনায় পরিবার ও সমাজের মানসিক সমর্থনও অনেক সময় পাওয়া যায় না৷ গাইবান্ধার শিশু তৃষা কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রী সিমি আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার পর দেশব্যাপী অনেক হইচই হয়েছে৷ নারী আন্দোলনের কর্মীরা বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামও গড়ে তুলেছিল৷ কিন্তু এ পর্যন্তই৷ ইভটিজিং তাতে কমেনি৷ ইভটিজিং কেন হচ্ছে যৌন হেনস্থা পাশ্চাত্য দেশগুলোর থেকে ভারতবর্ষে বিশেষত আমাদের এ বাংলাদেশে অনেক বেশি ঘটে৷ যদিও এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য এখনো প্রকাশিত হয়নি৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েরা পুলিশের কাছে গিয়ে যৌন হেনস্থার কথা রিপোর্ট করে না৷ মারাত্মকভাবে আহত না হলে পুলিশ এ ব্যাপারে শুধু ডায়েরি নেওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু করে না বলে বহু অভিযোগ শোনা যায়৷ এফআইআর নেওয়ার ব্যাপারে পুলিশের যে অনীহা আছে, তা পত্রপত্রিকায়ও নানা রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে৷ বরং পুলিশ এ ব্যাপারে নারীদের আইনের সাহায্য না নিতেই উপদেশ দিয়ে থাকে৷ নারীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মূলত উত্ত্যক্ততা ও হয়রানিরসূত্রপাত ঘটে৷ পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতায় পুষ্ট সমাজ ভাবে নারীরা সব সময় পুরুষের অধস্তন, তাই তাদের সঙ্গে ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যায়৷ গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন, মিউজিক ভিডিও, সিনেমা ইত্যাদিতে নারীর উপস্থিতি এখন অনেকটাই যৌন বস্তু (sex object) হিসেবে৷ নাটক-সিনেমা-উপন্যাসে ইভটিজিংয়ের মাধ্যমে নায়ক-নায়িকার প্রেমের সূত্রপাত দেখতে দেখতে উঠতি তরুণরা নিজেরাও উত্ত্যক্ততাকে গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেয়৷ এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক অস্থিরতা প্রভৃতিও এই অপরাধের পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে৷ উত্ত্যক্ত করার পথ ধরে অপহরণ, ধর্ষণ, জোরপূর্বক বিয়ে, আত্মহত্যা, পরিবারের এলাকা ত্যাগ, মা-বাবা-ভাইয়ের হতাহত হওয়ার মতো ঘটনাও অহরহ ঘটছে৷ এর নেতিবাচক প্রভাব ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়ে পড়ছে, কিন্তু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কখনো কখনো একে একটি রোমান্টিক ইমেজ দিতে চায় এবং টিজিংকারী পুরুষদের ‘রোমিও’ বলে অভিহিত করে৷ রোমান্টিকতার আড়ালে ইভটিজিংয়ের কুফল বা নেতিবাচক পরিণতিগুলো তাই আমাদের চোখে পড়ে না৷ ইভটিজিং না যৌন হেনস্থা? টিজিংয়ের আভিধানিক অর্থ পরিহাস, জ্বালাতন ইত্যাদি? তাই ইভটিজিং শুনলে মনে হয়, সেটা দুষ্টুমি হতে পারে তেমন কোনো অন্যায় নয়৷ পাশ্চাত্যে অবশ্য এই শব্দটা ব্যবহার করা হয় না৷ এই আচরণ যৌন হেনস্থার (sexual harassment) আওতায় পড়ে৷ অনেকের মতে, ইভটিজিং শুধু অশ্লীল কথা বা অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে মেয়েদের বিরক্ত করা, অন্য পক্ষে যৌন হেনস্থার সঙ্গে দৈহিক জোরজবরদস্তি ও শ্লীলতাহানি যুক্ত থাকে৷ আবার কেউ কেউ যৌন হয়রানি ও ইভটিজিংয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন না? শুধু ‘ইভটিজিং’ কথাটা ব্যবহার করেন যখন যৌন হেনস্থা রাস্তায় ঘটে কিংবা যেখানে জনগণের চলাচল আছে, যেমন- বাস, পার্ক বা সিনেমা হলে৷ আর ‘যৌন হেনস্থা’ শব্দটা ব্যবহার করেন যখন ঘটনাটি ঘটছে অফিসে বা চার দেয়ালের অন্তরালে?৷ এইভাবে দুটির পার্থক্য করা দুরূহ৷ ইভটিজিং : দায়ী আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে ইভটিজিংয়ের শিকড় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যবোধের মধ্যেই মিশে রয়েছে৷ নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ও সহিংস সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নারী-পুরুষের অংশীদারিত্বমূলক, সহমর্মিতাপূর্ণ, দায়িত্বশীল, সুস্থ সম্পর্কের বিকাশের প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার৷ এ ব্যাপারে পরিবার থেকেই উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে, পরিবর্তন করতে হবে নেতিবাচক মানসিকতা৷ শিশুর বেড়ে ওঠা ও সামাজিকীকরণের মধ্যেই নারীর প্রতি এই বিদ্বেষ ও সহিংস মনোভাব আত্মস্থ হয়ে পড়ে শিশুর ব্যক্তিত্বের অংশে পরিণত হয়৷ পরিণত জীবনে যাকে মুছে ফেলা কঠিন হয়৷ তাই শিশুদের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে যাতে তারা মেয়েদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে৷ ক্ষমতাবান পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নির্মিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এ আচরণকে অন্যায় না বলে বরং উল্টোভাবে মেয়েটাকেই দোষী করা হয় এবং বলা হয় মেয়েটাই প্রলুব্ধ করেছে৷ ইভটিজিংয়ের মতো মেয়েদের প্রাণসংহারক একটি গুরুতর অপরাধকে হালকাভাবে দেখার এবং এর দোষ মেয়েদের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতাই এর ব্যাপ্তি বাড়াতে সহায়তা করছে৷ আমাদের রক্ষণশীল সমাজের ধারণা, মেয়েদের জায়গা ঘরে আর ছেলেদের জায়গা বাইরে৷ পরোক্ষভাবে তারা ইভটিজিংয়ের জন্য মেয়েদের ‘অশালীন পোশাক’ পরে রাস্তাঘাটে চলাচলকে দায়ী করে৷ হয়রানিকারীদের দায়ী না করে মেয়েদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাদের মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করে আর অপরাধীরা এ কাজ চালিয়ে যায়৷ সমাজের চাপ এবং সামাজিক বিভিন্ন কারণে মেয়েরা আইনের দ্বারস্থ হতে বিলম্বিত হয়৷ আইনের স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই আমাদের দেশে ইভটিজিংয়ের ঘটনা থেকে আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে৷ দেশের প্রচলিত যেসব আইনে ইভটিজিংয়ের কথা বলা হয়, ধারা (২৯৪ এবং ৫০৯), ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (ধারা ৭৬) দন্ডবিধির ৫০৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার জন্য কোনো মন্তব্য বা অঙ্গভঙ্গি বা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে তাহলে ওই ব্যক্তি এক বছর কারাদন্ড বা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে৷ যে ব্যক্তি অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কাজ করে বা কোনো প্রকাশ্য স্থানে বা সন্নিকটে কোনো অশ্লীল গান, গাথা বা পদাবলি গায়, আবৃত্তি বা উচ্চারণ করে তাহলে উক্ত ব্যক্তির উক্ত কাজকে অপরাধ হিসেবে ধরা হবে এবং উক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিন মাস পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ড, সঙ্গে জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে৷ অন্যদিকে মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রচলিত পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখান হতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজ দেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে যা কোনো গৃহ বা দালানের ভেতর থেকে হোক বা না হোক, কোনো মহিলা দেখতে পায় বা স্বেচ্ছায় কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোনো মহিলাকে পীলাকে অপমান বা বিরক্ত করে তবে সেই ব্যক্তি এক বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ডে অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডনীয় হবে৷ এ ছাড়া একই অধ্যাদেশের ৭৫ ধারায় সর্বসমাজে অশালীন বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শাস্তি হিসেবে তিন মাস মেয়াদ পর্যন্ত কারাদন্ডের বা পাঁচশ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে বলে বলা হয়েছে৷ কিন্তু এসব অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণের দায়িত্ব নিতে হয় অভিযোগকারীকেই, যা একটি দুরূহ কাজ৷ তাই আইনগুলো মেয়েদের উত্ত্যক্ততা প্রতিরোধে কার্যকরী নয়৷ এগুলোতে নারীদের উত্ত্যক্ত করার জন্য শাস্তির বিধান আছে সর্বোচ্চ মাত্র তিন মাস বা এক বছর জেল কিংবা দুই হাজার টাকা জরিমানা৷ জরিমানা আদায় না হলে কী করা হবে তার উল্লেখ নেই কোথাও৷ এই নূ্যনতম শাস্তির বিধান দিয়ে এ ধরনের অপরাধের প্রতিকার কতটা সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ৷ তা ছাড়া এই আইনগুলোর কথা সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা আইনজীবীরাও অনেকে জানেন না৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এ ইভটিজিংকে যৌন হয়রানির একটি ধরন হিসেবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যদিও ‘ইভটিজিং’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি৷ কিন্তু ২০০৩ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শর্তগুলোকে শিথিল করা হয়েছে৷ ফলে এর আওতায় ইভটিজিংয়ের ঘটনার আইনি প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ২০০৩ সালের সংশোধনীতে একটি নতুন উপধারা সংযুক্ত করা হয়, যাতে কোনো নারী সম্ভ্রমহানির কারণে আত্মহত্যা করলে আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান করা হয়েছে৷ তবে এখানে সম্ভ্রমহানির কোনো সংজ্ঞা বা আওতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি৷ এ আইনে বলা হয়েছে, যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুর শরীর স্পর্শ করলে বা শ্লীলতাহানি করলে শাস্তির বিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ বছরের ও সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড৷ তবে স্পর্শের প্রসঙ্গ থাকায় তা হয়রানি বা আত্মহত্যায় প্ররোচনার ভেতর পড়ে না৷ ফলে এর আওতায় ইভটিজিংয়ের কারণে আত্মহত্যার শিকার মেয়েরা যে এ আইন থেকে প্রতিকার পাবে না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ তাই প্রয়োজন ইভটিজিং সংক্রান্ত একটি সুনির্দিষ্ট ও কঠোর আইন৷ যখন প্রতি বছরই আত্মসম্মান রক্ষায় বা বিচারহীনতায় নির্যাতিতরা আত্মহত্যায় বাধ্য হচ্ছে তখনো কেন আইনের ব্যাখ্যার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে? আমাদের দেশে এত বাঘা বাঘা আইনবিদ থাকতেও আজও একটি অপরাধের যথাযথ ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়নি? ইভটিজিংয়ের ফলে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যা জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী নারীর ওপর যে কোনো ধরনের দৈহিক, জৈবিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন করা বা করার চেষ্টা করা নারী নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত৷ যা থেকে স্পষ্ট যে নারী নির্যাতন কেবল দৈহিক নির্যাতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷ ইভটিজিং বর্তমানে নারী নির্যাতনের একটি নতুন হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে৷ একসময় সমাজের বখে যাওয়া একটি ক্ষুদ্র অংশই শুধু ইভটিজিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন উঠতি বয়সী তরুণ, কিশোর, যুবকরা তো আছেই; মধ্যবয়সীরাও এর অন্তর্ভুক্ত৷ এর ফলে যে ধরনের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় সেটিও অনভিপ্রেত৷ ভয়ভীতি পার হয়ে যখন নির্যাতিত মেয়েটি পরিবারে সদস্যদের কাছে ঘটনাটি খুলে বলে তখন পরিবারের মূল্যবোধের কথা চিন্তা করে মেয়েটির জীবনের সব আশা-আকাংক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে বিয়ের মাধ্যমে তাকে ঠেলে দেওয়া হয় ভিন্ন এক জগতে৷ প্রথম আলোর ২০০৬ সালের ২১ এপ্রিলের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাজিতপুরে এসএসসি পাস করার পর ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা তাদের কন্যাসন্তানকে ভৈরবের ছাত্রীনিবাসে পাঠিয়ে দিয়েছেন? কিন্তু দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জীবনের আশা-আকাংক্ষার যবনিকা টানতে হয়৷ অথচ এই জঘন্য অপরাধের জন্য কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না৷ অনুসন্ধানে আরো দেখা গেছে, উত্ত্যক্ততাকারী এসব বখাটে ছেলের বেশির ভাগই সচ্ছল পরিবারের সন্তান৷ সমাজে তাদের ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত থাকে৷ ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় না৷ যদি কোনো অভিযোগ করা হয় তাহলে ভিকটিম পরিবারকেই তার খেসারত দিতে হয়৷ ইভটিজিং মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ আমাদের সংস্কৃতিতে নারীর সম্ভ্রম বিবেচনা করা হয় সতীত্বের দিক বিচার করে? অথচ একজন নারী সমাজের কিছু বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ দ্বারা সম্ভ্রম হারালে তখন মেয়েটিকেই অসতী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়৷ মেয়েটি তাই সম্ভ্রমহীন-অর্থহীন জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে৷ প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজের মেয়েরা কি এভাবে বলি হয়েই চলবে? আর আমরা একটু আহা-উঁহুর মধ্য দিয়েই আমাদের যাবতীয় দায়িত্ব শেষ করবো? সভ্যতার বড়াই করবো? চাই সামাজিক প্রতিরোধ ইভটিজিংয়ের ফলে আমাদের সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷ ইভটিজিংয়ের কারণে মেয়েরা স্বাভাবিক সব সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে প্রথাগত গৃহবধূর ভূমিকায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়, ফলউন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে৷ সব মিলিয়ে আপাতদৃষ্টিতে কম ক্ষতিকর মনে হওয়া এ ঘটনাটির জন্য জাতিকে অনেক বড় মূল্য দিতে হয়৷ তাই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে৷ মেয়ের পাশাপাশি একটি ছেলের মানসিক দিকটিও ভাবতে হবে৷ মেয়েদের বলা হয় সবকিছু মুখবুজে সহ্য করো৷ এ সংস্কৃতি আমাদের ত্যাগ করতে হবে৷ সব সংগঠন, কর্মক্ষেত্রগুলোর ভেতর এসব নিয়ে আলোচনা করতে হবে৷ যেহেতু এটা একটা সামাজিক সমস্যা তাই এতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে৷ সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং এ অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে৷ ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ নারীকে দন্ড ও যোগ্য মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের অবশ্যই নীরবতা ভেঙে রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত ও হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে৷ তা না হলে মেয়ে শিশুর জীবন বিকাশের জন্য একটি বৈষম্য-নির্যাতনমুক্ত সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না৷ নিজের মাকে যথাযথ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার মধ্য দিয়েই একটি ছেলে নারীকে শ্রদ্ধা করতে শেখে৷ ভোগের পণ্য হিসেবে না দেখে বন্ধু হিসেবে দেখতে শেখে৷ আসুন আমরা উঠতি বয়সের ছেলেদের বোঝাই, আমাদের লেখালেখি, চলচ্চিত্র, নাটক সব মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি৷ আমরা যেন কোনো চলচ্চিত্রে না দেখি নায়ক নায়িকাকে উত্ত্যক্ত করছে, আর কিছুক্ষণ পর নায়িকা নায়কের সঙ্গে প্রেম জুড়ে দিয়েছে৷ আমরা যেন আমাদের ছোট ভাইদের দেখার চোখকে পাল্টে দিতে পারি৷ তারা তাদের মেয়ে সহপাঠীকে ভাববে বোন কিংবা বন্ধু; ভোগ্য বস্তু নয়৷ আসুন, এই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের যুগে, যে যুগে মেয়েরা হরহামেশা পণ্য হচ্ছে, পদদলিত হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, সে যুগে কিশোরদের মনে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলি৷ কারণ তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ।