ফেইসবুক এবং মেয়েদের ইভটিজিং

Share on facebook
Share on google
Share on twitter
Share on linkedin

ফেসবুক ব্যাপারটি মাঝে মাঝে এতো অবাক করে আমাকে, আনন্দিত করে, আলোড়িত করে, আবার করে তোলে বিরক্ত, উত্যক্ত এবং মাঝে মাঝে পাগলপ্রায়। বেশকিছুদিন থেকে ফেসবুক বন্ধুত্ব ব্যাপারটি নিয়ে কাছের দু’একজন নারী বন্ধুর সাথে আলাপ করলাম। তাদেরও কমবেশি আমার মতন অভিজ্ঞতা। তাই ভাবলাম একটু শেয়ার করি সবার সাথে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটু অন্তর্মুখী মানুষ, কাছের জনেরা ছাড়া অনেকসময়ই লোকজন না জানি কেন আমার এই একটু অন্তর্মুখিতাকে অহংকার হিসাবে বিবেচনা করে। কেন যে তা আজো বুঝে উঠতে পারি না। যাই হোক, ফেসবুকে আমার পদচারণা ২০১০ সাল থেকে হলেও সক্রিয়তা মূলত ২০১২ থেকে। আমার অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্যই ফেসবুকে আমার বন্ধুর সংখ্যা তিন সংখ্যার অংক ছাড়াতে পারেনি। এর মধ্যে ভাই-বোন, আত্মীয়-সহকর্মী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুর সংখাই প্রায় ৫০ ভাগের বেশী। নিজে থেকেই একটি পরিমাপক ঠিক করে নিয়েছিলাম যে কমপক্ষে দশ জন মিউচুয়াল বন্ধু না থাকলে কারো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করবো না। আর ওই দশ জনের মধ্যেও কমপক্ষে ছয়জন ব্যাক্তিগত পরিচিত থাকতে হবে। যার ফলে ফেসবুকীয় বন্ধুত্ব আমার তেমন বড় নয়। কিছু আছে ভাইদের বন্ধু-বান্ধব। আপু, আমাকে অ্যাড করেন প্লিজ। আচ্ছা করলাম অ্যাড। তারা আমার সবকিছুতেই লাইক দিবে, কমেন্ট করবে, নিজেরাও সারাক্ষণ কিছু না কিছু আপ করছে- খুব লাইভলি। ভালই লাগে। ইদানীং টুকিটাকি লেখার সূত্রে কিছু মানুষ আমার ফ্রেন্ডলিস্টে এসেছেন বা আমি তাঁদের ফ্রেন্ডলিস্টে জায়গা পেয়েছি। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যিকার অর্থেই আমার জানার পরিধিকে আরও বিস্তৃত করেছেন, আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন। অনেক সময় ভাবি, ইস, আরও আগে পরিচয় হলে আরও কত ভালো হতো। আবার কারো কারো সাথে কালেভদ্রে যোগাযোগ হয়, দু একটা লাইক, হালকা কমেন্ট কোন লেখার উপরে এই পর্যন্ত। কিছু ফেসবুকীয় বন্ধু আছেন, যারা কখনই পাবলিকলি কোন কমেন্ট করবেন না, কিন্তু ইনবক্সে মন্তব্য করবেন। কোনও লেখা ভালো লাগলে সেটাও ইনবক্সে, কোনও সমালোচনামূলক কমেন্টও ইনবক্সে। একটু অবাক লাগলেও ঠিক আছে। উপরের এই চার শ্রেণীর বন্ধুত্ব আমাকে কোনও না কোনভাবে সমৃদ্ধ করে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবি তাদের সাহচর্যে। পঞ্চম ধরনের কিছু ফেসবুকীয় বন্ধু আছেন, যাদেরকে আমি নাম দিয়েছি ‘দি ফিফথ ফ্লিট’- যারা বেশীরভাগ সময় আমাকে বিরক্ত, ত্যক্ত, উত্যক্ত এবং প্রায় পাগল করে তোলার ব্রত নিয়ে থাকেন এবং শেষঅবধি তাদেরকে শুধু আনফ্রেন্ড নয়, ব্লক করে দিতে হয়। এদের নিয়েই আজকের গল্প এবং এটা শুধু আমার একার নয়, আরও বেশ কয়েকজনের। এই শ্রেণীর বন্ধু শুরু করেন ইনবক্সে এইভাবে, হ্যালো, হাই, কেমন আছেন? কেউ কেউ হাসি মুখের ইমো দেন। যদি বা হ্যালোর উত্তর ভদ্রতাবশত দেয়া হলো, তবেই সারলো! আপনি কোথায় থাকেন? আপনার সংসারের গল্প করেন প্লিজ। একজন জানতে চাইলেন, আপনার স্বামী কি করেন, কোথায় থাকেন? বললাম, ভাই, আপনি কথা বলছেন আমার সাথে, স্বামীর ইনফরমেশনে ঠিক কি দরকার তাতো বুঝতে পারছি না। এবং আমি চুপ থাকলেও তারা কিন্তু ইনবক্সে কথা চালিয়েই যান- মনলগে আলাপ করার মতন! আনফ্রেন্ড না করা পর্যন্ত আপনার ইনবক্সে ঘটাং ঘটাং বাজতেই থাকবে। কেউ আবার বলবে, আপনি কোথায় পড়ালেখা করেছেন? কোথায় চাকরি করেন? বলতে ইচ্ছে করে, বেয়াদব, প্রোফাইল দ্যাখ। আনফ্রেন্ড বাটনে চাপ দেই, ওটাই সহজ! কেউ বলেন, আপনি এত সুন্দর কেন! বলি, ভাইরে, আমাকে বিরক্ত করার বদলে মান্না দে’র গান শুনেন, ভালো লাগবে- ‘ও কেন এত সুন্দর হল…!’ আমার এক বন্ধুর অনুষ্ঠানে বন্ধুর সাথে আমার ছবি দেখে, মন্তব্য- আচ্ছা, উনি কি আপনার বিশেষ বন্ধু? নাছোড়বান্দা সেই ফেসবুকীয় বন্ধু সেই বন্ধর সাথে আমার সম্পর্কের নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করার ব্রত নিয়েছেন। ব্লক করা ছাড়া উপায় কি? আচ্ছা, আসলেই কি আপনি একলা থাকেন? জানতে চাই, কেন ভাই, আপনি কি এসে থাকার কথা চিন্তা করছেন নাকি? বন্ধুকে এই কথা বলার সাথে সাথে বুদ্ধি বাতলায়, ‘ব্লক মার’! টিভি’র বিজ্ঞাপনের সেই ‘ব্লক মেরে দাও’ কথাটি এখন আমাদের কাছের বন্ধুদের ভেতর জনপ্রিয়। ফ্রেন্ড লিস্টে অ্যাড করার পরদিনই একজন ইনবক্সে লিখলেন, মনে হয় আপনাকে শত জনম ধরে চিনি যেন! আমার তো আক্কেলগুড়ুম। বললাম, ভাই, আমার বয়স তো এখনও পঞ্চাশও হয় নাই, এই একশ বছরের হিসাব কোথা থেকে এলো? একজন বললেন, আপনাকে খুব প্রেমময়ী মনে হয়, বললাম, জী জনাব, সাহসী নারী এবং পুরুষ আমাকে খুবই টানেন। সাহসী মানুষের প্রেমে আকুল হই। আপনার সাহসের পরিধি মেপে নিন, প্রথমে তারপরে প্রেম প্রস্তাব দিয়েন! এক বন্ধুর বাড়ীতে পরিচয় দেশের একজন নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্তার সাথে। অনেক কথা বলার সাথে ফেসবুক আইডি বিনিময়ও হল। ভ্রমর কইও গিয়া, বন্দে মায়া লাগাইছে, সোনার ময়না পাখী- ইত্যাদি গানের ইউটিউবে ইনবক্স সয়লাব। ব্লক মারতেও পারছি না। আবার ফ্রেন্ডলিস্টে নাই এমন মানুষ ইনবক্সে এমন সব ভাষা ব্যবহার করেন যে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রাইভেসি আরও টাইট করা ছাড়া উপায় থাকে না। ভাবি, কোনদিন এই প্রাইভেসির ঘেরাটোপে নিজের আইডেন্টিটিই না আবার আটকা পড়ে যায়। এতো গেল আমার মতন চুনোপুঁটি’র কথা। আমার সাংবাদিক বন্ধু, হাজারে-বিজারে তার ফেসবুকীয় ফ্রেন্ড। প্রফেশনের কারণেই তাকে এতো লোকের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। আমার যন্ত্রণার কথা শুনে বন্ধু হাসে, আরে এইগুলা তো কিছুই না, বড়জোর চিমটি কাটা, আমাকে মাঝে মাঝে বর্শার আঘাতও সইতে হয়। বন্ধু জানালো, গত কয়দিন থেকে সে উপদ্রুত হচ্ছে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা দ্বারা। লোকটি ইনবক্সে তাকে ফুল-পাখি-লতা-পাতার ইমো দিয়ে যাচ্ছে সমানে। এবং সেই সাথে প্রেমের কবিতার দু’এক চরণ! জেলা শহরে বসবাস করে সেই শহরের সর্বজ্যেষ্ঠ সরকারী কর্তাকে চটিতং করানোর কোন উপায় নাই। বন্ধু না পারে আনফ্রেন্ড করতে, না পারে সইতে, চ্যাট বক্স অফ করে রাখে সে! আজই তার এক স্ট্যাটাসের উপরে দেখলাম একজন মন্তব্য করেছে, আমি কি আপনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারি। আমি সাথে সাথে ফোন করলাম, বন্ধু ব্যাপার কি? শুনলাম, এই লোক নাকি অনেকদিন থেকেই তাকে ফলো করে ফেসবুকে, তো আজকে সে ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড করেছে। এবং করা মাত্র তার ইনবক্সে একটি লাল গোলাপের ইমো এবং লোকটির জীবন ধন্য হয়ে যাবার গল্প এবং বন্ধুর ব্লক মারাও শেষ! অনেকদিন থেকে একজন তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, প্রায় কুড়ি জনের মতন কমন ফ্রেন্ড, তো এড করেছে। পাত্তা না পাওয়ার একপর্যায়ে, লোকটি আমার বন্ধুকে যা-তা ভাষায় গালি গালাজ- অতএব ব্লক মার! একজন বললেন, আচ্ছা, আসলেই কি আপনি বিবাহিত? স্বামী’র কথা শুএকজন বললেন, আচ্ছা, আসলেই কি আপনি বিবাহিত? স্বামী’র কথা শুনি না, ছবি দেখি না! বন্ধু বলল, তাতে তোর কিরে বরাহনন্দন! তারপরেই ব্লক। কেউ কেউ বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন- সেই অতি পুরাতন রোগ, চিকিৎসাও সনাতনী- ব্লক মার! সবচেয়ে অবাক করা কাহিনী ছিল, কোনও এক ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক পরিচয়ের এক ব্যাক্তি তাকে ‘মামনি’ ডাক দিয়ে শুরু করে ক্রমশ যেসব ভাষা ব্যবহার করা শুরু করেছিল, আমার বন্ধু সেই লোককে ব্লক করার পরেও বেশ কিছুদিন ভয়ে ফেসবুক খোলে নাই। বন্ধু আমার তার ফেসবুকীয় বন্ধু লিস্টে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ শুরু করেছে। মাত্র শ দুয়েক কাটা পড়েছে এপর্যন্ত। এতো গেল পুরুষ ফেসবুকীয় বন্ধুদের কথা, কিছু নারীও আছেন এই দলে। আচ্ছা, আপনি কি কারো সাথে প্রেম করেন? আপনার পুরুষ বন্ধুর সংখ্যা অনেক নিশ্চয়ই! তাদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন নিশ্চয়ই। সবই যদি নিশ্চয়ই করে জানেন, তবে আমায় কেন বিরক্ত করছেন মা জননী! আনফ্রেন্ড। একলা থাকেন বলেই সৌন্দর্য ধরে রাখতে পেরেছেন। কি কি করেন আপনার ফিগার মেইনটেইন করার জন্য? আনফ্রেন্ড। আচ্ছা, শরীর কষ্ট দেয় না? কি করেন? উত্তর দেই, আপনার স্বামী বা পুরুষ বন্ধুটির ফোন নম্বর দেন প্লিজ। তখন সে নিজেই আমাকে আনফ্রেন্ড করে! আরও একটা ব্যাপার যেটা ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত অনেকের বেলায়ই প্রযোজ্য, কোনও একটা স্ট্যাটাসে এমন অসংবেদনশীল মন্তব্য করবে যে কিছু করার থাকে না মন্তব্যটি ডিলিট করা ছাড়া! জানি না, পুরুষেরা এইসব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যান কিনা, জানতে ইচ্ছা করে। তবে এই ফেসবুক একটা ব্যাপার পরিষ্কার করেছে আবারো, টেকনোলজি মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে যেমন নিতে পারে, আবার এর অতি ব্যবহার বা অপব্যবহারও নেহাত কম নয়। এই সবেরই শেষ সমাধান হিসাবে আনফ্রেন্ড অথবা ব্লক। সংযোজন এবং বিয়োজন এত সহজ এই ফেসবুকীয় বন্ধুত্বে। তাই হয়ত বিরক্তি থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু মনের মধ্যে একটা কথা ক্রমাগত বেজে চলে, মিনিমাম সভ্যতা, ভদ্রতা, অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানো, এগুলো কবে শিখব আমরা?

shawon

shawon

Leave a Replay

About

VOICE was established in 2001. VOICE was established with the mandate of creating linkages not only between policy-makers and the communities at the grassroots level, but also between organizations through partnership, networking, and information exchange in the community.

Recent Posts

Follow Us

Follow Us