পর্নোগ্রাফি, যৌন হয়রানি, ইভটিজিং ইত্যাদি। মোবাইল ও ইন্টারনেটে বাংলাদেশের পর্নোগ্রাফি এখন সর্বকালের সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় আছে। সেলিব্রেটি বা পেশাদারীদের প্রকাশ্য-গোপন যৌন চিত্র, ভিডিও ছাড়াও রয়েছে অপেশাদার বা হয়রানি মূলক চিত্র ও ভিডিও যা হরদম প্রচারিত হচ্ছে। মোবাইলে, পেন ড্রাইভে বা সিডি-ডিভিডিতেও ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে নগ্নতা। কয়েক বছর আগে একজন অভিনেত্রীকে নিয়ে ইন্টারনেটে যা করা হয়েছে তাতে তার দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। হতে পারে যে, প্রকাশিত ভিডিওটি সত্য নয়। কিন্তু একটি পরিবার যে ধ্বংস হয়েছে সেটি কয়জনে উপলব্ধি করেছেন। এরপর একজন তরুণী মডেলের ভিডিও চিত্র বলে প্রচার করার পর জানা গেল যে সেটি ওই মডেলের নয়। কিন্তু ইন্টারনেটের সেই প্রচারণায় সেই মেয়েটির যে সর্বনাশ হলো সেটি প্রচারকারী ইন্টারনেট মাধ্যম বা কাগজের মাধ্যম বিবেচনা করেনি। পত্রিকার পাতায় ফলাও করে সেই খবরটি ছাপা হয়ে গেল। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ইন্টারনেট যৌন হয়রানির একটি বড় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এমনকি শিশুরা পর্যন্ত এই অপরাধ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পথে-ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে বা পরিবারে ইভটিজিং নামক যে ব্যাধির বিষয়ে এখন বেশি প্রচারণা হচ্ছে ডিজিটাল অপরাধ যে তার চাইতে অনেকগুণ গুরুতর ও ক্ষতিকারক সেটি আমাদের ধীরে ধীরে উপলব্ধির আওতায় আসতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই ভয়ঙ্কর ব্যাধি পুরো দেশটাকেই আক্রান্ত করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এসব অপরাধ এখনো প্রতিরোধ করতে ভালোভাবে জানি না- ডিজিটাল পর্নোগ্রাফি আইন থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের আগে আমরা এর বিচারের উপায়ও খুঁজে পাইনি। ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে ইভটিজিংয়ের বিচার করা যাচ্ছে- কিন্তু মোবাইলে বা ইন্টারনেটে যখন অপরাধ হচ্ছে তার জন্য রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। রাষ্ট্র যেন এখনো বুঝতেই পারছে না যে পথে-ঘাটের ইভটিজিংয়ের চাইতে ডিজিটাল অপরাধ আরো হাজারগুণ ক্ষতিকর ও ভুক্তভোগীর জন্য বেদনাদায়ক। আমাদের এটি বুঝতে হবে যে শারীরিকভাবে কাউকে ইভটিজিং করার চাইতেও ভয়ঙ্কর হতে পারে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাউকে যৌন হয়রানি করা। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, এসএমএস ইত্যাদির মাধ্যমে ছবি ও লেখার মাধ্যমে যেসব নির্যাতন হয়ে থাকে তা আতঙ্কজনক। এসব প্রযুক্তি পর্নো, নোংরা লেখা ও ছবি দ্রুত ও ব্যাপক প্রসারেও ব্যাপক সহায়তা করে থাকে। ব্যক্তিগত আক্রমণ একেবারে ব্যক্তিগত একটি দৃষ্টান্ত দিয়েই অবস্থাটির বিবরণ দেয়া যায়। আমার পরিচিত কোনো এক বন্ধু তার বোন একটি মেইল আমার কাছে ফরোয়ার্ড করেছে। তার কাছে চাওয়া সমাধানটির জবাব তিনি আমার কাছে চেয়েছেন। এই মেইলটিই বাংলাদেশের তরুণীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার একটি চিত্র তুলে ধরে।
ক. ‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, আমি আনিকা। আশা করি ভালো আছেন। আমি আপনার কাছে একটি সমাধান চাই। কেউ একজন আমার ছবি আর বিবরণ দিয়ে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছে। সেখান থেকে লোকটা যাকে খুশি তাকে বন্ধুর রিকোয়েস্ট পাঠায়, বাজে পেজ লাইক করে এবং আজেবাজে মন্তব্য করে। আমার দেয়ালে নোংরা পোস্ট দেয় ও নোংরা ছবি পোস্ট করে। আমার এই ফেক আইডির দেয়ালে এমন সব ভিডিও আছে যা কোনো সভ্য মানুষ দেখতে পারে না। একই সঙ্গে সে আমাকে নাস্তিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। আমি এখন কি করব? আমার কি অপরাধ যে আমি একটি মেয়ে এবং এ জন্য আমি নিজের সম্মান রক্ষা করতে পারব না। দেশে কি কোনো সরকার নেই, কোনো কর্তৃপক্ষ নেই যে আমি অভিযোগ করতে পারি বা সহায়তা পেতে পারি। আমার মোবাইলে যেসব সমস্যা হয় সেগুলোর কথা না-ই বললাম। আশা করি আপনি সহায়তা করবেন।’ ।
খ. আমি একজন অধ্যাপিকাকে জানি যাকে তার এক ছাত্র পরীক্ষায় নকল ধরার দায়ে ফেসবুকে তাকে পতিতা বানিয়ে ছেড়েছে। নগ্নবক্ষা একটি ছবিতে তার মাথাজুড়ে দেয়া হয়েছে।
নারীর প্রতি অনলাইনে সহিংসতার মাত্রা এত বেশি যে এটি পুরো সভ্যতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, আমাদের দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসানের নামে ফেসবুকে একটি আইডি খুলে তার মাধ্যমে যারা অভিনয় করতে আগ্রহী তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে নেয়া হচ্ছে। জাহিদ হাসান বিষয়টি জানার পরে সেই লোকগুলোর সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিশ্চিত হন যে, এভাবে তারা টাকা উপার্জন করছে এবং মানুষ প্রকৃত জাহিদ হাসান বিবেচনা করে প্রতারিত হচ্ছে। এরপর তিনি জনগণকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু জাহিদ হাসান সতর্ক করে দিলেই কতজন তার সেই সতর্ক বার্তা পেয়েছে কে জানে। এ ছাড়া তিনি সতর্ক করে দেয়ার আগেই বেশ কিছু প্রতারণার ঘটনা ঘটে গেছে ।
গ. ২০১৩ সালে একটি পত্রিকায় দুটি খবর প্রকাশিত হয়। একটি খবর হলো; কোনো এক শিক্ষক তার ছাত্রীর অশ্লীল ছবি বানিয়েছে এবং সেটি পোস্টার বানিয়ে দেয়ালে লাগিয়েছে। অন্যটিও একই প্রকারের। কোনো এক মাদ্রাসা ছাত্রীর মুখটার সঙ্গে একটি নগ্ন মেয়ের ছবি যুক্ত করে সেটির পোস্টার দেয়ালে লাগানো হয়েছে। এই দুটি অপরাধ করা যেত না যদি কম্পিউটারে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি সম্পাদনার সুযোগ না থাকত। এই দুটিই সাইবার ক্রাইম। আমরা ইন্টারনেটে প্রায়ই দেখি যে কারো কারো ছবি বিকৃত করা হচ্ছে। কাউকে জুতার মালা, কাউকে অপমানকর বক্তব্য এবং কাউকে কাউকে বাক্যবানে হেয় করার প্রচেষ্টা চলছে।
ঘ. ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভুয়া ছবি-ভিডিও তৈরি করে আপনাকেই মেইলে পাঠানো হতে পারে। আপনার মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে আপনার নামে আপনার জন্য ক্ষতিকর মেইল অন্যের কাছে পাঠানো হতে পারে। ইন্টারনেটে ইউটিউব হচ্ছে ভিডিও সন্ত্রাসের জায়গা। সেখানে কেবল যে পর্নো ছবি প্রচার করা হয় তাই নয়, ব্যক্তিভাবে আক্রমণ করার জন্য ব্যাপকভাবে ইউটিউবকে ব্যবহার করা হয়। এটি রাজনৈতিক অপপ্রচারেরও হাতিয়ার। ব্লগে মিথ্যাচার, বাজে মন্তব্য ও অন্যকে আক্রমণ করা একটি মুল কারন। সমাজে ইভটিজিং যেমন করে মেয়েদের বিপর্যস্ত করছে, ইন্টারনেটেও প্রধানত তারাই অধিকতর নির্যাতিত হচ্ছে। যেহেতু ইন্টারনেট একটি গণমাধ্যম সেহেতু এখানে যে অপকর্মগুলো করা হয় তা যেমন করে পাবলিক হয়ে যায় তেমনি এর বিস্তারও ঘটে দ্রুত। একটি মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যদি একটি বখাটে বাজে মন্তব্য করে তবে তা হয়তো দুচারটি লোকের চোখে পড়ে। কিন্তু যখন কেউ ইন্টারনেটে সেই কাজটি করে তখন লাখো কোটি মানুষের সামনে সেটি পৌঁছে যায়। ফলে সাধারণভাবে যদি কোনো অপরাধ ঘটে তবে তার যা ক্ষতি এর চাইতে বহুগুণ ক্ষতি হয় ইন্টারনেটে। যে কাজটি প্রকাশ্যে করা যায় না সেটি গোপনেও করা উচিত নয়। একই অবস্থা হয়েছিল মুন্নী সাহাকে নিয়ে। মিথ্যা বা অপপ্রচারের সঙ্গে নোংরা ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগও সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, খেলোয়াড়, অভিনয়-সঙ্গীত শিল্পী, সেলিব্রেটিসহ এমন কোনো স্তরের মানুষ নেই যারা ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন না। ডিজিটাল প্রযুক্তির অপপ্রয়োগ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তো এমন প্রযুক্তি রয়েছে যা দিয়ে ভিডিওতে, ছবিতে বা অডিওতে পরিবর্তন করে ফেলা যায়। খুব সহজেই একজন মানুষকে অন্য মানুষে রূপান্তর করা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির সহজলভ্যতাও ডিজিটাল অপরাধের জন্য সহায়ক হয়ে উঠেছে।